সত্যসাধনের পুজো
বুকটা চিন চিন করে উঠলো সত্যসাধনের। পুজোয় আর জগু আসবে না। হাবুও আসবে না।
কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায় উঠে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, আলো ফুটছে আলতো। বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। দিগন্তে কমলা আভা। দুটো মোরগ ডেকে উঠলো। হালকা ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন একটু দূরে।
আজ কি ষষ্ঠী? ঠিক মনে করতে পারলেন না বছর আশির সত্যসাধন। সপ্তমীও হতে পারে! অঞ্জলি ঘুম থেকে উঠলে জিগ্যেস করবেন!
ঘড়িতে ছটা ছুঁইছুঁই, অঞ্জলি উঠেই বললেন, “চম্পা আজ দেরি করে আসবে। চা করছি এক্ষুণি।”
-“আজ কি ষষ্ঠী? না সপ্তমী?”, উদ্বিগ্ন সত্যসাধন, যেন কী করে কাটাবেন পুজোর এ’কটা দিন।
-“ষষ্ঠী। নিজেই বাজারে যেও আজ, হাঁটা হবে। আর শোনো, অষ্টমীর দিন, ঢাকি-কাঁসি খাবে, একটু মিষ্টি রাখতে বোলো দোকানে।”
সকালের রোদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, সত্যসাধন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন জাগতিক কর্মকাণ্ডে, ভোরের অস্থির মনখারাপটা সামলে নিলেন একটু।
দৈনন্দিনতায় ক্লিষ্ট জীবনে মাঝে মধ্যে ক্লান্ত লাগে সত্যসাধনের। বাজার থেকে ফিরে, অঞ্জলিকে জিগ্যেস করলেন, “সোহিনী ফোন করেছিল?”
-“করবে করবে! পুজোর সময়! ব্যস্ত আছে বোধহয়!”
সোহিনী অঞ্জলি-সত্যসাধনের একমাত্র সন্তান, সত্যসাধনের জীবনীশক্তির উৎস, আজও।
দীর্ঘ জীবনে, সত্যসাধন অনেক পুজো অনেকভাবেই দেখলেন। আগে ভাবতেন, তিনি একাকী, কিন্তু নিঃসঙ্গ নন। বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের যাতায়াত ছিলই আগাগোড়া। সববয়সের মানুষজনের সঙ্গেই মেশেন সত্যসাধন। খুব কাছের দুই বন্ধু, জগু আর হাবুর চিরতরে চলে যাওয়ার পর, আজকাল হাঁফিয়ে ওঠেন প্রায়ই। স্ত্রীর কথা ভাবেন, কি হবে অঞ্জলির তিনি হঠাৎ চলে গেলে!
সপ্তমীর দিন সকাল সকালই এলো চম্পা, অঞ্জলির হেল্পিং হ্যাণ্ড। সত্যসাধন-অঞ্জলির ওপর খুব মায়া চম্পার। বারবার বলে দিলেন অঞ্জলি, “কাল একটু বেলা পর্যন্ত থাকিস, চম্পা, একটু লুচি-তরকারি করতে হবে, তুই থাকলে খুব সুবিধে হয় রে!’
সন্ধিপুজোর সময় পুজোমণ্ডপে গেলেন সত্যসাধন। ভীড়-জনস্রোতের মধ্যে সত্যসাধনের মনে হল – বেঁচে থাকাটাই কি সব কিছু! তারপরেই কি হারিয়ে যাওয়া, মিলিয়ে যাওয়া!
সন্ধেবেলায় সত্যসাধন লক্ষ্য করলেন, অঞ্জলি লুচি বেলছেন। চম্পা চলে গেছে।
-“ঢাকি-কাঁসি খেয়ে গেছে?”, জিজ্ঞাসু সত্যসাধন।
-“অনেকক্ষণ।”
-“আবার বানাচ্ছো?”
-“ফুরিয়ে গেছে।”
-“কতগুলো করেছিলে?”
-“চল্লিশটার মতো হবে। আজ বড় আনন্দ হলো। খাইয়ে। আজকাল তো কেউই ভালো করে আর খায় না।”
আর কথা বাড়ালেন না সত্যসাধন। পাশের ঘরে এলেন। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অঞ্জলি এ রকমই! পঞ্চাশ বছর হতে চললো, এক সঙ্গে আছেন। পাড়া-প্রতিবেশী সবার সঙ্গে যোগসূত্র অঞ্জলিই। সত্যসাধন বাইরের কাজকর্ম, উপার্জন, এই সব নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন। সোহিনীকে মানুষ করা, সংসার সামলানো, সব অঞ্জলি একা হাতে। পিছন দিকে তাকিয়ে সত্যসাধন ভাবেন, নেহাত মন্দ কাটলো না এই জীবন!
নবমী। বাজার করে, ফিরে, সত্যসাধন, “কি রে, আজই চলে এলি? সনৎ আসেনি? বলিস নি তো আজ আসবি?”
সোহিনী সকাল সকাল চলে এসেছে মা-বাবার কাছে, ছেলে সন্তুকে নিয়ে। একটু সারপ্রাইজ দিতে ভালোবাসে সোহিনী, ছোটো থেকেই। তার ওপর, বাবা-মার শুধুই দুশ্চিন্তা, ঝগড়া করেছিস সনৎ-এর সঙ্গে ইত্যাদি। বলল, “একাদশীর দিন আসবে।”
স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সত্যসাধন। ভাবলেন, সন্তুর সঙ্গেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে পুজোর বাকী ক’দিন।হাবু-জগু চলে যাওয়ার পর বড়ই একা লাগে তাঁর, প্রায়ই ভাবেন, আর ক’দিন!
নাতি সঙ্গে থাকলে নিজের কৈশোরকে খুঁজে পান তিনি। ছোটবেলার পুজো। মা-বাবা। গ্রামের পথঘাট, মাঠ-প্রান্তর। পুজোর পর পুজো কাটিয়ে জীবনের শেষ বিন্দুর দিকে এগিয়ে চলেছেন, বেশ উপলব্ধি করেন সত্যসাধন।
দশমীর রাতে ঘুমোবার আগে মা-বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ করলেন, প্রণাম করলেন।
সনৎ এলো একাদশীর সকালে। বিকেলে ফিরে যাবে, সোহিনী-সন্তুকে নিয়ে। সনৎ ও বাবার জন্য চা দিয়ে গেলো সোহিনী।
সোহিনী কোনো একটা গান গুনগুন করছে সকাল থেকে, বোঝা যাচ্ছে না পরিষ্কার। সত্যসাধনের হঠাৎ মনে হলো, ‘শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা / শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা।’ অন্যমনস্কভাবে ধূমায়িত কাপের দিকে দেখছিলেন এক দৃষ্টিতে। হুহু করে উঠলো ভেতরটা! জল এলো চোখে! এটাই কি তবে শেষ পুজো!