সময়টা এই বছরেরই জানুয়ারী, করোনা-ক্লান্ত পৃথিবী। পঞ্চাশোর্ধ এক প্রৌঢ় কথা বলছিলেন তাঁরই এক শ্রদ্ধার মানুষের সঙ্গে। হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রৌঢ়, উচ্চারিত হতে থাকল, “কেন আপনি আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন?”
ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে, স্তব্ধ বিস্ময়ে ভাবতে থাকি, আমরা অপমান-অবহেলাকে মানিয়ে নিতে নিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, একটুখানি খাঁটি স্নেহের স্পর্শে আমরা কাঁদি।
এমনটাই কি হওয়ার কথা ছিল? মানুষের সঙ্গে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম ভাল ব্যবহারটুকু করতে গেলে, বোধহয়, প্রথমেই জেনে নেওয়া প্রয়োজন “মানুষ হওয়া”-টা আসলে কি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আজ, এক বিশিষ্ট মানুষের প্রয়াণের দিনে। অমলেন্দু চক্রবর্তী। সাহিত্য়িক অমলেন্দু চক্রবর্তীকে সম্যক অনুধাবনের ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তাঁর লেখার পাতায় পাতায় যে উত্তরণের দিকনির্দেশ, চলুন, একটু চেষ্টা করা যাক, তাকে উপলব্ধি করে নিতে।
“আকালের সন্ধানে”-তে লিখলেন –
” ‘হয় না, বুঝলে হে, এ-হয় না…’ ভিন্নতর এক বিস্বাদে আচম্বিতে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ কিরণময় – ‘আকাল খুঁজতে এসেছ? এ-তো শুধু ভাতের হাঁড়ির আকাল নয় তোমাদের। গোটা দেশ জুড়ে বিদ্যেবুদ্ধির আকাল, চেতনার আকাল, অনেস্টির আকাল, ডিসেন্সির আকাল, টোটাল ফিলসফির আকাল … জানপ্রাণ দিয়ে খুব তো নাটক করছ। ফিল্ম বানাচ্ছ। সত্যি ভালো ফিল্ম, সাংঘাতিক ভালো একটা স্ক্রিপ্ট। কিন্তু হলে হবে কী! …. ‘ ”
কিছু কি বদলেছে আমাদের সমাজে? বারবার হেরে যাই আমরা, অন্যায় অবিচারে। মন ক্রমশ অবশ হয়ে যায় গভীর এক trauma-য়।
ঘুরে দাঁড়াবো কিভাবে তাহলে?
এই প্রশ্নের উত্তরের একটা ইঙ্গিত পাই, “যাবজ্জীবন”-এ। এ লেখায় এক গভীর আশার সাক্ষাৎ পাই। জীবনের যে কোন অবস্থানে, অত্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসেবে, একটা নিজস্ব জীবন নির্মাণের আশ্বাসই এই উপন্যাসের ভিত্তি।
” ‘ঘাবড়াও মাৎ, মাই ফেয়ার লেডি, একটা কিছু হবে। হতেই হবে’ … বড় রাস্তায়, জনতায় পৌঁছে উৎপল হঠাৎ চাঙ্গা – ‘লাইফটা হান্ড্রেড মিটার কি টু হান্ড্রেড মিটার রেস নয়। তাই যদি হতো, এই যে দেখছ এত মানুষজন, অনেকেই কেউকেটা ভি. আই. পি. বনে যেতে পারত দুনিয়ায়। ওই ছোট্ট রানটুকু কমপ্লিট করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব।’
কোনো সাড়া নেই শিপ্রার। বস্তুত আশাভরসা বা ভবিষ্যৎবাক্যে আর তার মাদকতাও নেই তেমন।
অথচ উৎপল তার দৃপ্ত ঋজুতায় – ‘লাইফটা আসলে, বুঝলে, ফিফটিন হান্ড্রেড মিটার রেস। ওতে ফার্স্ট ল্যাপ কি সেকেণ্ড ল্যাপে কে এগিয়ে রইল, কে পিছিয়ে রইল, ব্যাপারই নয় কোনো। খেলাটা লাস্ট রাউন্ডে। প্রাত্যহিকতার ওপরে ঘাড়টা লম্বা করে তাকাও একটু। অপেক্ষা করো আর তিনটে কি চারটে বছর..’ “
ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের মাঝে সন্ধান পাই, “মানুষ হওয়া”-র ঠিকানা। তার সঙ্গেই খুঁজে পাই উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক নির্লোভ অস্তিত্ব। বিশ্বাস জন্মায়, চিরকালীন মানদণ্ড, মূল্যবোধের একাল-সেকাল হয় না। সমস্ত compromise, সব adjustment-এর মধ্যেও, জীবনের এক শক্তপোক্ত foundational framework-এর দেখা মেলে এই লেখায়। এক ধ্রুব সত্যের মতো। জীবনের গতিপথের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হয় বারবার, সব ঠিক আছে তো? এদিক ওদিক হলো না তো? আমাদের ভাল হওয়ার, আমাদের ভাল থাকার, অনেকটাই বোধহয় আমাদেরই নিজস্ব সৃজন।
“আরো একটা কথা, তোমার মা বাবা এবং অন্যান্যরা হয়তো ক্ষুব্ধ হবেন, তবু তোমাকে নিভৃতে বলে রাখি – স্কুলকলেজের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা ভালো, অবশ্যই বিরাট কৃতিত্ব, কিন্তু জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। তার চেয়েও বড়, অনেক বড় অন্বিষ্ট – মানুষ হওয়া। এই মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা জানতে চেয়ো না। আমি জানি না। হয়তো কেউই জানেন না। পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গে, জাগতিক কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে সচেতন থেকে, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করতে করতে, একদিন নিজের মধ্যেই এই সংজ্ঞা আবিষ্কার করে নিতে হয়। নির্লোভ উচ্চাকাঙ্ক্ষায় যেদিন সেটা খুঁজে পাবে, সেদিনই তোমার যথার্থ পরিণত হয়ে ওঠা।”