পঁচিশে বৈশাখের দুঃখ
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘটনা, সাজিয়ে দিলাম বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্যে। জন্মদিনের, প্রতিদিনের।
—————————————————————————————————————–
দুঃখ–১
———
কয়েক বছর আগের কথা। “দূর দূর” রায়ের একটা গানের YouTube Link পাঠিয়ে, শুভদীপ লিখল, “নতুন শিল্পী, গানটা শোন। Ambulance নিয়ে যাচ্ছি কিছুক্ষনের মধ্যেই”। পনেরো–কুড়ি সেকেন্ড গানটা শুনে, মনটা খারাপ হল। এত অশ্রদ্ধা! Ambulance লাগেনি। জানালার সামনে গিয়ে, বাইরে তাকিয়ে আনমনা মিনিট খানেক। মনের ভারটা লাঘব হল একটু।
“আকাশপারে আবারও চোখ গিয়েছে আটকে
শরৎ মেঘে দেখতে পেলাম রবীন্দ্রনাথকে।”
-“মিথ্যে কথা”, শঙ্খ ঘোষ
———
দুঃখ–২
———
বারবার শুনছিলাম, “ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে” গানটি, সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে। মনে হল, Composition–টা যেন একটু অন্যরকম। Notes combination-এ বেশ একটা চঞ্চলতা। একটু মাদকতাও যেন। মনটা উতলা হয়ে ওঠে! খেয়াল করলাম, গানটিতে তিনবার “পাগল” শব্দটা আছে। কী মিলমিশ এই বাণী–সুরের!
হঠাৎ–ই সেই পুরনো দুঃখটা মোচড় দিয়ে উঠল। “উলা লা উলা লা….”-র “পাগলা হাওয়ার বাদল–দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে”। “পাগল”, “মাতাল” শব্দগুলোর কি উদ্দামতার দরকার হয়েছিল সেদিন? রবীন্দ্রনাথ, আমেরিকার জীবন ও সঙ্গীত, এবং বাঙালি জীবনের সমন্বয়ের ব্যত্যয়ে বোধহয় হারিয়ে গেছিল আনত শ্রদ্ধাটুকু।
সেকারণেই আজও বারবার ফিরতে হয়, শঙ্খ ঘোষে। দুঃখমোচনে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সৃষ্টিরহস্য উন্মোচনে। বোধের বিকাশে।
“জন্ম নিতে–না–নিতেই মরে যায় মুহূর্ত, পেতে–না–পেতেই হাতছাড়া হয়ে যায় পাওয়া। এই এক মৃত্যুগহ্বর ঘিরে আছে আমাদের সমস্ত জীবন। কিন্তু সেই মরণলোক থেকে উঠে আসে স্মৃতির পর স্মৃতি, কানাকানি হতে থাকে এ–পারে ওই–পারে। জীবনের দায় থেকে পালাই না আমরা, দু–হাত দিয়ে ধরতে চাই তার সমস্ত প্রত্যঙ্গ, মুখে নয় কোনো গ্লানির চিহ্ন, অমলের সৌন্দর্যে ভরে যায় দশদিগন্ত, নিজেকে উদ্গত করে তুলতে চাই উদ্ভিদের মতো সজীব – কিন্তু তারই মধ্যে বুকের পিছনে ধ্বনিত হতে থাকে ক্ষান্তিহীন এক গোপন স্বর : ‘ও চাঁদ, চোখের জলে লাগল জোয়ার’।
এই জোয়ার থেকে জেগে ওঠে রবীন্দ্রনাথের গান।”
-“এ আমির আবরণ” গ্রন্থের “মর্ত্য কাছে স্বর্গ যা চায়” প্রবন্ধ, শঙ্খ ঘোষ
———
দুঃখ–৩
———
অনেক অনেক দিন আগে, Brand Positioning–এর ওপর একটি Video দেখার সুযোগ হয়েছিল। দেখিয়েছিলেন কলকাতার তদানীন্তন Advertising গুরু, সুব্রত সেনগুপ্ত।
বিদেশের এক মধ্যবিত্ত পাড়ায় একটি মোটর গাড়ী এসে থামল। পাড়া চঞ্চল তৎক্ষণাৎ। লোকজন বেরিয়ে এসে, ঘিরে রইল গাড়ীটাকে। সাদাকালো Video–য় দেখানো হল, Jaguar ।
শুধু একটা গাড়ী নয়, ব্যক্তি, জিনিস, সিনেমা, এমন কী একটা দেশেরও Brand Positioning–এর প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জীবদ্দশায় Product endorse করেছেন, নিজের Celebrity status ব্যবহার করে। একদম পারিশ্রমিক ছাড়া। মূলত স্বদেশীয়ানাকে Promote করতে।
তবুও এই সেদিন আবার বেদনাহত হলাম। “ঘরে বাইরে আজ” সিনেমায় “ঘরে বাইরে” শব্দদ্বয় ব্যবহার করে, বাণিজ্যকরণের প্রয়াসে। রাজনৈতিক–সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটা ক্ষীণ সাযুজ্য ছিল হয়তো, তবুও বুঝতে অসুবিধে হয় না, Brand Personality হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নামটার একটা ইঙ্গিত, সেই বহুচর্চিত Content–এর মোড়কে, কিছুটা অশ্রদ্ধার কালিমালিপ্ত।
“A brand that captures your mind gains behaviour
A brand that captures your heart gains commitment”
– Scott Talgo, Brand Strategist
সুব্রত সেনগুপ্তর Brand Positioning বই থেকে।
———————————————
আছ অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি
———————————————
রবীন্দ্রভারতীর Masters মেয়েটি, রবীন্দ্রসঙ্গীতেই। ওর বিয়ের আগে বলেছিলাম, “যেখানেই যাবি, হারমোনিয়ামটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবি। ওটা কিন্তু আদতে কল্জে!”
এখন সে গৃহিনী। মা। স্ত্রী। পুত্রবধু। গান তেমন গাওয়া হয় না ওর। এই সেদিন বলছিল, “দু’কলি গাইলেই, চোখে হুড়মুড়িয়ে জল। কিন্তু কী আশ্চর্য ! গাল বেয়ে নামার সময়ই কে যেন পরম যত্নে মুছে দিয়ে যায়! কে যে সে!”
“জীবন চরিতে তাঁকে সত্যিই খোঁজা যায় না
কাল রাতের বেলায় এত গান, সর্বাঙ্গ জড়ানো গান
সেই সব সুরের মীড় ছবির রঙের মতন গড়িয়ে যায়, আয়তনে মেশে
যেন মাতিস্–এর আঁকা গান, ঝর্ণায় অনেকক্ষণ ধারাস্নান
চোখ জড়িয়ে আসে
তারপর একঝলক স্বপ্ন দেখি আলখাল্লা পরিহিত তাঁকে
এ মূর্তি প্রভাত মুখুজ্যের গড়া নয়, বইয়ের র্যাকের পাশে ঠেস দিয়ে
থুতনিতে আঙুল, বড় ব্যাকুল ও কৌতূহলী, খুবই মহান ও সামান্য
আমার কোন প্রশ্ন আসে না
কান্নায় আমার গলা বুজে যায়, আমি ফুঁপিয়ে উঠি
একটু পরেই দেখি ঘামে ভিজে গেছে বিছানার চাদর
বাইরে প্যাঁচার ডাক শিহরিত রাত, থমথমে পৃথিবী
কুয়াশার মতন ছড়িয়ে পড়ে আমার বিস্ময়
রবীন্দ্রনাথকে দেখে হঠাৎ আমার কান্না এলো কেন
আমারও কান্না জমে ছিল?
আঃ বেঁচে থাকা এত আনন্দের!”
-“কাল রাতের বেলায়”, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়